মাঝে মাঝে অদেখা কোনও এক সময়ের নস্ট্যালজিয়া গ্রাস করে। যেসময়ের সাথে কখনও দেখা হয়নি, যে সময় কোনওদিন মুহূর্ত হয়ে উঠতে পারেনি, সেই সময়টাই হাতছানি দেয়। বিজয়ার পরের দিনটা ঠিক সেরকমই হয়। ছোট থেকে দেখে আসছি। সেদিন সব লাউডস্পিকার থেমে গেছে, প্যান্ডেলে গুঞ্জন নেই। ফাঁকা চন্ডীমন্ডপটার কান্না থেমে গেলেও এখনও খানিক ফোঁপাচ্ছে। ওদিকে বিকেলের বারান্দায় তখন ঘুমলাগা এক আলোর মায়া…আর ঘরের ভিতরে সেই দেখা না হওয়া সময়ের হাতছানি। স্পিকার নয়, যেন সেই কাঠের রেডিও উহুঁ.. কলের গান.. বেজে উঠছে, লতাজী গাইছেন, “অজীব দাস্তাঁ হ্যায় ইয়ে… না উয়ো সমঝ সকে না হম…”, রেকর্ডের ওপিঠে আবার হয়ত … “কাঁটো সে খিচ কে ইয়ে আঁচল…”, সে গানের সুরে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হয়… গান বলে কাঁদো, মায়ের হাতের ঝালর লাগানো ফুলকাটা বালিশের ওয়াড় বলে কাঁদো, ঠাকুরদার ঘড়িটা বলে কাঁদো… বাবার সিগারেটের বাক্সটা বলে … কাঁদো… কাঁদো মন… কাঁদো… কি যে বিষাদ জানা নেই, কোথায় যে মন খারাপ.. কে জানে… তবু মনে হয় কাঁদি, সেই ছুঁতে না পারা সময়কে ভেবে কাঁদি…সেই তৈরি না হওয়া মুহূর্তের জন্য কাঁদি…আর তখনই চোখ পড়ে বারান্দার রেলিংয়ের ভিতর দিয়ে আসা দিনের শেষ জাফরিকাটা আলোটুকুর দিকে। ছুটে যাই… ছুঁতে যাই, সেই আলোয় পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি… ঘরে লতাজী গাইছেন.. সামনের ফোঁপাতে থাকা চন্ডীমন্ডপও দেখি গলা মেলাচ্ছে…”ইয়ে শাম যব ভি আয়েগি.. তুম হমকো ইয়াদ আওগে…”
২.
মাঝরাত ও রবীন্দ্রনাথ
কতখানি রিক্ত করতে পারেন তিনি আর কতটাই বা পূর্ণ হয়ে উঠি বারবার, রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে। এই গোপন বিজন ঘরে, এই নীরব শয়ানে একেলা থাকা, রিক্তই তো করেছেন তিনি বারবার… তবুও কেন জাগাতে চাই , কেন বলে উঠি আমার মন মানে না, কি স্মরিয়া বারংবার পুলকিত হয়ে গোপনে মুছে নিই উথলে ওঠা নয়নবারি…কে ভেসে আসে ওই ভাঙনের পথ দিয়ে, সুপ্ত রাতে…বুঝতে কি পেরেছি, পেরেছি কি জানতে, শুধু কি এক হতাশ্বাস শূন্যতায় খুঁজে চলেছি তাকে, আশ্রয় চেয়েছি ফের তাঁর কাছেই… ছোঁয়ার চেষ্টা করেছি নীরব সেই গান, যা আসলে তাঁরই তো দান। এলোমলো হয়ে যাওয়া সব ভাবনা গুছিয়ে নিতে ফিরে এসেছি ফের তাঁরই কাছে, কি এক বিপুল আকুতিতে বলে উঠেছি, “প্রিয়তম হে জাগো, জাগো, জাগো…”, সবটুকুর শেষে কেন বারবার ফিরে আসি সেই কোণটুকুতেই, সে প্রশ্নের উত্তর হয়ত অধরাই থাকবে, তাঁকে জানা তো শেষ হয় না কখনও, চকিতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো কোন অনুভূতিকে দিশেহারা করে সিন্ধুপারে চাঁদ না ওঠা রাতটির মতোই আড়াল হবেন তিনি। পথের কাছে তাঁরই ফেলে যাওয়া মালাটিকে বুকে জড়িয়ে একলা নয়নজলে ভেসে যাওয়াটুকু পরে থাকে হাতের মুঠোয়, ভেবে নিই নতুন করে, এ হয়ত তাঁরই দান। আসলে বাহির পানে চোখ মেলেই তো কাটিয়ে দিয়েছি সময়ের অধিকাংশটা, ভিতরে দেখার অবসরটুকু মিলল কই.. তাই তো আজও ঠিক ততটাই অধরা তিনি, ঈশ্বরের মতো। সকল আঘাত, সকল আশার মধ্যে যে তিনিই লুকিয়ে ছিলেন, বুঝতে এতগুলো দিন, মাস, বছর কেটে গেল। আবার কাল সকাল হবে, এই অসমর্থ দৃষ্টি নিয়ে বাহির পানেই তাকাবো ফের, হাতড়ে মরবো শূন্যতার গহ্বরে পূর্ণতা, রিক্ত হবো, হবো নিঃস্ব… তারপর আবার কোনও একদিন সেই তিনিই এসে বসবেন পাশে, তাঁরই খোলা হাওয়ায় পাল তুলে ভেসে যাব… আবার… বারবার…
January 22, 2020 — magnon