একটি লোকালাইজেশন এজেন্সি বা স্থায়ীয়করণ সংস্থা হিসেবে আমাদের স্থানীয়করণের বিষয় ফরম্যাল বা নন-ফিকশন বিভাগের আওতায় আসে। তাই প্রায় প্রতিদিন আমরা অনুবাদ ও সেই সংক্রান্ত বিষয়ে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হই। উদাহরণ হিসেবে কবিতার স্থানীয়করণের বিষয়টি ধরা যেতে পারে। যদি একটি কবিতা অনুবাদ নয়, স্থানীয়করণ করতে হয়, তাহলে কীভাবে সেই কবিতার মূল ভাব, আবেগ বজায় রেখে অন্য একটি ভাষায় সেটিকে রূপান্তরিত করা সম্ভব, এটাই মূল চ্যালেঞ্জ। ম্যাগনন পুরো বিষয়টি কীভাবে দেখে তা দেখে নেওয়া যাক।
অনুবাদের সবথেকে সৃজনশীল ক্ষেত্র সম্ভবত কবিতার স্থানীয়করণ বা ভাবানুবাদ। ভাবানুবাদ মূলত কবিতার ভাব, শৈলি, ভঙ্গি ও বিষয়বস্তু প্রায় এক রেখে এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ের রূপান্তর। সফলভাবে ভাবানুবাদের জন্য একজন ভাষাবিদকে নিছক অনুবাদকের ভূমিকা থেকে এসে মনন ও মস্তিষ্কের অনুভূতির কেন্দ্রস্থলে ডুব দিতে হবে। এখানে কিছু প্রশ্ন আছে ভাবানুবাদের সময় যা বারবার নিজেকে করতে হবে।
- বিষয়বস্তুর মূলভাবটি কি? শব্দগত বা পোষাকিভাবে হয়ত মানে অন্যকিছু দাঁড়াবে কিন্তু নিহিতার্থ বিচারে বসলে দেখা যাবে মানেটাই বদলে গেল। আসলে খ্যাতনামা কবিতার ক্ষেত্রে সাধারণত এমনটাই ঘটে থাকে। পাশাপাশি, কোন কবিতাকে সম্পূর্ণভাবে আত্মীকরণ করতে গেলে তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জেনে নেওয়াটাও জরুরি।
- কবিতা বা কবিতার নিহিতার্থের ভঙ্গি কেমন? তা কি দৃপ্ত প্রতিবাদী না মোলায়েম মৃদু? ভঙ্গির মধ্যে সোজাসুজি বক্তব্য দেওয়া আছে নাকি ব্যাঞ্জনার মাধ্যমে বর্ণিত? কবিতার আঙ্গিকে কি লোকগীতির ছোঁয়া আছে নাকি ভক্তিরসের উদগার?
- কবিতার সম্ভাব্য পাঠক কারা? এটি কি সাধারণ শিক্ষিত জনসাধারণ নাকি শহুরে শিক্ষিত জনতা? এই অনুবাদ কি সেই পাঠকের কাছে পৌঁছাবে যাদের জন্য সেটি লেখা হয়েছে? যদি তা না হয় তাহলে ভাবানুবাদ আরও সরলীকৃত করার প্রয়োজন আছে কি?
- যে পাঠকদের লক্ষ্য করে লেখা হয়েছে, তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মূল কবিতার কতখানি অংশ আত্মীকৃত হতে পারে আর কতখানি হতে পারে না? যে ভাব এবং ভঙ্গি মূল কবিতায় ব্যবহার করা হয়েছে তা কি পাঠকদের কাছে সঠিকভাবে গ্রহণীয়? যদি তা না হয়, তাহলে বিশেষণ, কাব্যিক মুড বা চলন ভঙ্গিমায় বদলের প্রয়োজন আছে কি?
- পাঠকদের মধ্যে এই কবিতার ভাষা কি প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে? এই প্রশ্নটি যদিও দ্বিতীয় প্রশ্নটিরই অপর পিঠ বলা যেতে পারে। সেই প্রতিক্রিয়া অনুযায়ী আমাদের শব্দচয়ন আর কবিতার ভঙ্গিমা বদলের দিকটি বিবেচনা করতে হবে।
উপরোক্ত সব প্রশ্নের উত্তর ভালোভাবে বিবেচনা করার পরেই সৃজনশীলতার জুতোয় পা গলিয়ে যে ভাষায় ভাবানুবাদ করতে চাই সেখানে কলমের জাদু দেখানো শুরু করা যেতে পারে। তাই, এটা বলা ভুল হবে না যে, ভাবানুবাদ আসলে অন্য কোন ভাষা থেকে প্রাণিত হয়ে একটি সম্পূর্ণ নতুন লেখার জন্ম দেওয়া। আত্মীকরণ করা মূল কবিতার প্রায় পুরোটাই নতুন ভাষা, শব্দচয়ন, সংশ্লিষ্ট পরিবেশ এবং সম্ভাব্য পাঠককূলের অন্তরের অন্তঃস্থল স্পর্শ করবে ঠিক ততোটাই, যতটা করেছে মূল কবিতাটি।
যদি একজন অনুবাদক এই বিষয়টি না বুঝে যদি শুধুমাত্র অনুবাদ করে যান তাহলে পুরো বিষয়টি তার মাধুর্য্য হারাবে। আর তার থেকেও খারাপ হলে, পুরো কবিতা লোকজনের হাসাহাসির কারণ হবে।
অবশ্য, দৈনিক কাজের ক্ষেত্রে আমাদের কবিতা বা সৃজনশীল কাজ রোজ রোজ ভাবানুবাদের প্রয়োজন পড়ে না। ভাবানুবাদ মূলত সৃজনশীল লেখা, বিপণন মূলক বিষয়, বিনোদনের জন্য সাবটাইটেল ইত্যাদির মতো ক্ষেত্রে কাজে লাগে। এই ধরনের ক্ষেত্রে সংস্কৃতি, দেশ কালের সীমা এবং অবশ্যই ভাষা নির্বিশেষ কোন ব্যান্ডের বাণিজ্যিক সাফল্যের জন্য কার্যকরী ভাবানুবাদ ভীষণ জরুরি।
কারণ শেষপর্যন্ত, মানবিক আবেগ ভাষার সীমারেখায় আবদ্ধ থাকেনি। সেই কারণেই সঠিকভাবে ভাবানুবাদ হলে ভাষা, দেশ, কাল নির্বিশেষে সব মানুষ যেকোন লেখা পড়ে সেই সেই একই আনন্দ, বেদনা, উদ্দীপনা বা বলা ভালো মূল লেখার সব ভাব ঠিক ঠিক ধরতে পারবেন।
বাংলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হোক বা হিন্দীতে পীযূষ মিশ্রা, তামিলে সুব্রমনিয়ম ভারতী বা কন্নড়ে কে.এস. নরসিমাস্বামী, সঠিকভাবে ভাবানুবাদ এঁদের কাউকেই কেবলমাত্র একটি ভাষার মধ্যে আবদ্ধ করে রাখবে না। করে তুলবে সার্বজনীন।
আপনি কি এমন কোন ভাবানুবাদ (ভালো হোক বা ততটা ভালো নয়) পড়েছেন, যা কিনা আপনার মন ছুঁয়েছে বা একেবারেই প্রভাবিত করতে পারেনি? এখানে মন্তব্য করুন। আপনার কথা, আমরা শুনব।
December 11, 2018 — magnon