“Interlinking of rivers”–আরেকবার ভেবে দেখা দরকার

Written by: Sakthi S

Translated by: Pamela B

“চেরাপুঞ্জির থেকে,
একখানি মেঘ ধার দিতে পার গোবি-সাহারার বুকে?”
-“ঘুমের ঘোরে”
যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত

কোথাও অতিবৃষ্টি আবার কোথাও অনাবৃষ্টি, ভারতবর্ষের অনেক বৈচিত্র্যের মধ্যে বোধহয় এটাও অন্যতম। একপ্রান্তে আছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত সম্পন্ন জায়গা চেরাপুঞ্জি, অন্যপ্রান্তে রয়েছে বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম মরুভূমি থর, রাজস্থানের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে। কোথাও বন্যার জলে ভেসে যাচ্ছে গ্রাম থেকে শহর, আবার কোথাও একফোঁটা বৃষ্টির জন্য হাহাকার। কেমন হত, যদি কবির কল্পনার মতোই চেরাপুঞ্জি থেকে একটু বৃষ্টি এনে ফেলা যেত রাজস্থানে? বা বন্যায় দুকূল ছাপিয়ে যাওয়া নদীর জল দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া যেত অনাবৃষ্টিতে খরাকবলিত কোনও অঞ্চল… কেমন হত? এই ভাবনাকেই বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে আল্ট্রা মেগা প্রজেক্ট “Interlinking of rivers”, ভাবগতভাবে তর্জমা করলে বলা যেতে পারে, “নদীগুলির পারস্পরিক জলবন্টন”। ভারতীয় উপসমাদেশে উত্তরাংশ, উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ ভারতের বিবিধ নদীকে কোনও একভাবে যুক্ত করে দেশের জলসম্পদ সঠিকভাবে পরিচালনা করার উদ্দেশ্যেই এই বিশাল প্রযুক্তিগত প্রকল্পের প্রস্তাবনা করা হয়েছে। এই প্রকল্পের সঠিক রূপায়ণ হলে উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে বন্যার প্রবণতা কমবে এবং বন্যার সেই অতিরিক্ত জল ভারতের খরাপ্রবণ বা খরা কবলিত এবং দ্বীপাঞ্চলে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে যেখানে জলের চাহিদা বিশাল।
——————————————————————————————————————-
“নদীগুলির পারস্পরিক জলবন্টন” ভারতে বর্তমানে “হাই প্রায়োরিটি প্রজেক্ট” এবং এটিকে জাতীয় প্রকল্প হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এই প্রকল্প রূপায়ণের জন্য পরিবেশগত এবং বন দফতর থেকে সবুজ সঙ্কেত সহজেই পাওয়া গেছে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, এই প্রকল্পের গুরুত্ব কতখানি। কিন্তু এটা শুধুমাত্র প্রদীপের আলোকিত দিকটুকু। প্রদীপের নিচের অন্ধকারের মতো এই প্রকল্পের একটি ধ্বংসাত্মক দিকও আছে। রাজনৈতিক নেতারা খুব সহজেই যে বিষয়টি অবহেলা করে এড়িয়ে গেছেন। তাঁদের মতে, এই প্রকল্প দেশে সুখ ও সমৃদ্ধি আনবে। বহু প্রকৃতিবিদ এবং পরিবেশবিদ সরকারের নদীগুলির পারস্পরিক জলবন্টন প্রকল্পের বিরুদ্ধে। তাঁরা জানিয়েছেন, এই প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হলে ভালোর থেকে বেশি এমন কিছু চিরস্থায়ী ক্ষতি হতে পারে যা ভবিষ্যতে কখনও পূরণ করা যাবে না। তাই এই প্রজেক্টকে কখনই জাতীয় প্রকল্প হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে না এমনকি এর বাস্তবায়নও উচিত নয়।
লক্ষ কোটি বছর আগে নদীর উৎপত্তি এবং তার গতিপথ প্রকৃতির নিজের নিয়মে হয়েছে। অঞ্চল বিশেষে বদলে গেছে নদীর গতিপথ, সেই নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সভ্যতা, তার নিজের নিয়মে। প্রথমে খরস্রোতা প্রবাহ থেকে ধীরে ধীরে মোহনায় এসে সাগরের সঙ্গে মিশে যাওয়া। অনেক নদী আবার নিজস্ব নিয়মে কাস্পিয়ান সাগর এবং অরাল সাগরের মতো বিশাল আবদ্ধ জলাশয়েও মেশে। বিশাল আকারের জন্য সেগুলিকে সাগর হিসেবে অভিহিত করলেও আদতে সেগুলি বিশালায়তন প্রাকৃতিক হ্রদ বা আবদ্ধ জলাশয়। আসলে প্রকৃতির মতো সহজ সরল আর কিছু হয়ত না আবার সেই প্রকৃতির রহস্য বুঝে ওঠাও অত সহজ না।

প্রতিটি নদী নিজেই এক একটি বাস্তুতন্ত্র। নিজের উৎপত্তি থেকে সাগরে মিশে যাওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন প্রজাতির জীবের বেঁচে থাকার প্রক্রিয়া ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে আছে এই নদীগুলির সঙ্গে। নদীরগুলির পারস্পরিক জলবন্টনের জন্য সেগুলিকে যুক্ত করা প্রয়োজন কিন্তু তার মানে এই নয় যে সেগুলিকে খালের মাধ্যমে যুক্ত করা। জীবজগতের জীবনধারণের উপর মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পগুলির অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যার অবশ্যম্ভাবী ফল হল অপূরণীয় ক্ষতি। ইতিমধ্যেই আমরা দেখেছি যে নদীর গতিপথ বদলানোর চেষ্টা করলে মানবজাতি ও প্রকৃতির উপর কি ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়ে।

১৯৫০-৬০-এর দিকে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নে (ইউএসএসআর) অরাল সাগরের দিকে প্রবাহিত হতে থাকা সব নদীর ধারা দেশের খরাপ্রবণ অঞ্চলের দিকে ঘোরানো হয়েছিল, সেচ এবং কৃষিকাজের জন্য। বছরের পর বছর ধরে যখন প্রায় সব নদীর গতিপথ ঘোরানো প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে এসেছে এমন সময় দেখা যায়, অরাল সাগর ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম হ্রদ অরাল সাগর, হ্রদ হওয়া সত্বেও শুধুমাত্র তার বিপুল আকারের জন্যই সাগর হিসেবে পরিচিত। মানবসম্পদ উন্নয়ননের ধারা কি বিপুল পরিমাণে ক্ষতিকারক এবং ধ্বংসাত্মক হতে পারে, অরাল সাগর তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। ১৯৯০ সালে অরাল সাগরের আয়তন ১০ শতাংশ কমে যায় এবং সেখানে পাওয়া যায় না আর কোনও মাছ। ক্রমে অরাল সাগর একটি মৃত সাগর হয়ে যায়। অরাল সাগরে মাছ না পাওয়া স্থানীয় অর্থনীতিতে বিশাল প্রভাব ফেলে। স্থানীয় মৎসজীবিরা কার্যত কর্মহীন হয়ে পড়েন। পাশাপাশি, যে মরু অঞ্চলে কার্পাস চাষের জন্য নদীর গতিপথ বদল করা হয়েছিল, সেই চাষও খুব ফলপ্রদ হয়নি। প্রাথমিকভাবে কিছু লাভের মুখ যদিও দেখা গেছিল। সেই অঞ্চল একসময় কার্পাসের সবচেয়ে বড়ো রফতানিকারক অঞ্চলের খ্যাতিও পেয়েছিল। কিন্তু তাও বেশি সময়ের জন্য নয়। কয়েকবছরের মধ্যে গতিপথ বদলানো নদীর ৩০-৭৫ শতাংশ জল নষ্ট হতে শুরু করে খালপথে লিকেজের কারণে পাশাপাশি প্রাকৃতিকভাবেও জলের প্রবাহও কমতে থাকে। ফলস্বরূপ এই বিশাল প্রকল্প ক্রমে বৃহত্তর বিপর্যয়ের আকার ধারণ করে। ইউনেসকো অরাল সাগরের এই নদীর গতিপথ পরিবর্তন প্রজেক্টকে “বিশ্বের অন্যতম দুর্ভাগ্যজনক” “প্রাকৃতিক বিপর্যয়” হিসেবে ঘোষণা করে।

নিজেদের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে কাজাখাস্তান ও উজবেকিস্তানের সঙ্গে একযোগে সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন অরাল সাগরকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অরাল সাগর এখন ” অরালকুম মরুভূমি” নামে পরিচিত।

প্রাকৃতিক বাস্তুশাস্ত্র নিজের মধ্যেই জটিল একটি প্রক্রিয়া। যার মধ্যে উন্নয়নের নামে মানুষের হস্তক্ষেপ অপূরণীয় ক্ষতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। ভারতে, “নদীগুলির পারস্পরিক জলবন্টন” প্রকল্পের জন্য প্রথমেই চাই খালপথ, বাঁধ এবং জলাধার তৈরির জন্য বিশাল জমি। যার জন্য বহুলাংশে বনাঞ্চল চিরস্থায়ীভাবে কেটে ফেলার প্রয়োজন পড়বে। যার কুপ্রভাব পড়বে অরণ্যবাসী জীবকূলের উপর। ধ্বংস হয়ে যাবে তারাও। প্রাণীকূলের ভারসাম্য বিঘ্নিত হওয়া যার অবশ্যম্ভাবী ফল। ভারত বিশ্বের বৈচিত্র্যময় ১২ টি দেশের মধ্যে একটি। বাকি দেশগুলি হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, পেরু, ভেনিজুয়েলা, ব্রাজিল, কঙ্গো, দক্ষিণ আফ্রিকা, মাদাগাস্কার, মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, পাপুয়া নিউ গিনি, চিন এবং অস্ট্রেলিয়া। অরণ্য ধ্বংস হলে ভারত এই গরিমাও হারাবে তা বলাই বাহুল্য়।

এই প্রজেক্ট গোটা দেশে আর্থ-সামাজিক ভারসাম্যের উপর অকল্পনীয় প্রভাব পড়বে। লক্ষাধিক দরিদ্র মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়বে, লক্ষ লক্ষ হেক্টর কৃষিজমি চিরকালের জন্য জলের নীচে ধ্বংস হবে। আসলে, প্রকৃতি মানুষের হাতের ক্রীড়নক হয়ে থাকার কোনও বিষয় নয়, তাই মানুষ নিজের ইচ্ছেমতো প্রকৃতির সঙ্গে ভাঙচুর করতে পারেনা। করলে সেই ফল হবে ভয়ঙ্কর। মনে রাখতে হবে, প্রকৃতির সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে এই গোটা প্রাণীকূল। ছোট্ট একটি প্রজাপতি থেকে শুরু করে অরণ্যচারী পশু পর্যন্ত সবাই। প্রকৃতির গায়ে আচড় টানা মানে, সেই আচড়ের সংক্রমণ গ্রাস করবে তাদেরও এবং পরোক্ষে সেই প্রভাব পড়বে মানুষ জাতির ওপরেও। ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবো আমরাও।

অ্যালবার্ট আইনস্টাইন সঠিকভাবেই বলেছিলেন “If the bee disappeared off the face of the Earth, man would only have four years left to live”.

উন্নয়নের নামে প্রকৃতির সঙ্গে ছেলেখেলা করার অর্থ পরোক্ষে আত্মহত্যার দিকে পা বাড়ানো।

References:
http://mowr.gov.in/schemes-projects-programmes/schemes/interlinking-rivers
https://www.indiatvnews.com/news/india-pm-modi-rs-5-5-lakh-crore-river-linking-project-ambitious-plan-deal-with-droughts-floods-400170
https://www.downtoearth.org.in/coverage/the-debate-on-interlinking-rivers-in-india-13496
https://timesofindia.indiatimes.com/india/govt-may-declare-inter-state-river-linking-projects-as-national-projects/articleshow/62544432.cms
https://www.jagranjosh.com/general-knowledge/advantages-and-disadvantages-of-interlinking-rivers-in-india-1506409679-1
https://www.geoecomar.ro/website/publicatii/Nr.19-2013/12_mehta_web_2013.pdf

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *