আঞ্চলিক মার্কেটিং যেকোনও গড়পড়তা টেক কোম্পানির প্রায় এক তৃতীয়াংশ বিনিয়োগের ক্ষেত্র এবং এর মূল লক্ষ্য দুটি: স্থানীয় অঞ্চলে চাহিদা সৃষ্টি এবং ব্র্যান্ডটিকে বলিষ্ঠভাবে উপস্থাপনা করা।
ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে যে প্রজন্ম বলীয়ান, যে প্রজন্ম গুগল সার্চ ও অনলাইন অ্যাডের সাথে বড় হয়েছে, সেখানে নিছকই স্টক ফটো এবং স্ট্যান্ডার্ড মেসেজ দিয়ে আঞ্চলিক বলয়ে ব্র্যান্ডের প্রসার ঘটানো কষ্টসাধ্য। আর ঠিক এই প্রসঙ্গেই, ভাষার স্থানীয়করণ বা লোকালাইজেশন এবং কোনও ধারণা বা পণ্যকে বাজারজাত করার সফল প্রচেষ্টায় সম্পূরক হিসেবে কাজ করে আঞ্চলিক গ্রাহক ও সংস্কৃৃতির জ্ঞান।
2011 সালের সেনসাস বা জনগণনা অনুযায়ী ভারতে 19500টিরও বেশি ভাষা বা উপভাষা রয়েছে এবং দেশের জনসংখ্যার 96.71 শতাংশই তাদের মাতৃভাষায় কথা বলে।
বাংলা বা বঙ্গ নামে যে ভূ-খণ্ড বর্তমানে বাঙালির আবাসভূমি হিসেবে চিহ্নিত, তা প্রাচীন সময়ে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনপদে বিভক্ত ছিল। এইসব অঞ্চল পুণ্ড্র, বঙ্গ, সমতট, হরিকেল, বরেন্দ্র, তাম্রলিপ্ত, দণ্ডভুক্তি ইত্যাদি নানা নামে পরিচিত ছিল। এখনকার পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা প্রায় দশ কোটির কাছাকাছি। ভারতের পূবদিকে অবস্থিত এই রাজ্যে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে বাংলা ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের ওঠা-পড়ার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে এই রাজ্যের সমৃদ্ধ কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের অজানাকে জানা ও অচেনাকে চেনার আগ্রহে জীবনযাত্রায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। তাছাড়া 1947-এ দেশ বিভাগের পরে কয়েক কোটি শরণার্থী মানুষ এদেশের বিভিন্ন রাজ্যে চলে আসে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সত্তরের দশকে পূর্ববঙ্গ থেকে কয়েক লাখ মানুষ বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় বসবাস করতে শুরু করে। কালের প্রভাবে ধীরে ধীরে এপার বাংলায় গড়ে ওঠে মিশ্র ভাষা, সংস্কৃতি ও রন্ধনশৈলী।
বাংলা (রাজ্য এবং ভাষা) ও বাঙালিকে বুঝতে হলে ভাষা ও সাহিত্যের কথা না বললেই নয়। প্রথমেই বলে রাখি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহ্য হাজার বছরের বেশি পুরনো। অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত গীতিপদাবলি চর্যাপদ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত। মধ্যযুগে বাংলা ভাষায় কাব্য, লোকগীতি, ও পালাগানের প্রচলন ঘটে। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে বাংলা কাব্য ও গদ্যসাহিত্যের ব্যাপক বিকাশ ঘটে। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাঢ় বাংলার তথা বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, অচ্যিন্তকুমার সেন, তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ গুণীজনেরা যুগের পর যুগ ধরে বাংলা ভাষায় সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। বঙ্গের সহস্রাব্দ প্রাচীন ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ অপর এক ঐতিহ্যের বাহক হল বাংলা সঙ্গীত। বাউল গান, রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুলগীতি ও অন্যান্য প্রাদেশিক ঐতিহ্যবাহী গান এমন এক অনন্য সম্পদ যা সহজেই মানুষের মন ছুঁয়ে যায় এবং আঞ্চলিকীকরণের দারুণ এক মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে।
যেকোনও সংস্কৃতি বা সভ্যতা মূলত দুইভাবে গড়ে ওঠে ও প্রসারিত হয়, নগরকে কেন্দ্র করে ও গ্রামকে কেন্দ্র করে। পশ্চিমবঙ্গের প্রকৃত সৌন্দর্য সম্পর্কে জানতে হলে লোকসংস্কৃতির কিছু কথা নিয়ে আলোচনা করা যাক। বিভিন্ন পরব, নাচ, গান, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদির মধ্য দিয়ে বাংলার ঐতিহ্যকে পুষ্ট ও পরিপূর্ণ করেছে লোকসংস্কৃতি। পুরুলিয়ার ছৌ নাচ ও আদিবাসীদের টুসু পরব আঞ্চলিকভাবে খুবই জনপ্রিয়। লোকনৃত্য ও লোকগানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভূয়াং নাচ, চাং নাচ, পাতা নাচ, লাংরে নাচ, রায়বেঁশে নাচ, রণপা নাচ, ঝুমুর গান ও টুসু গান। এছাড়াও লুপ্তপ্রায় লোকনাট্যের মধ্যে রয়েছে চড়িয়া চড়িয়ানী, ললিতা শবর পালা, যা রাঢ় বাংলার লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে।
ঈশ্বর গুপ্ত বলেছেন, ‘এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ, তবু রঙ্গে ভরা।’ কথায় বলে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বাস এই রাজ্যে, তাই ঋতুবদলের সাথে তাদের আচারে, উৎসবে ও খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সামাজিক অনুষ্ঠানের মধ্যে প্রধান উৎসব দুর্গা পূজা এবং কালীপূজা, এছাড়া নবদ্বীপের শাক্ত রাস এবং কৃষ্ণনগর ও চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজা অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব হওয়ার পাশাপাশি বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যও বটে। সর্বজনীন উৎসবের মধ্যে পয়লা বৈশাখ প্রধান। গ্রামাঞ্চলে নবান্ন, পৌষ পার্বণ ইত্যাদি লোকজ উৎসবের প্রচলন রয়েছে। স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস এবং ভাষা আন্দোলনের স্মরণে একুশে ফেব্রুয়ারি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পালিত হয়। এছাড়াও ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ঈদ-উল-ফিতর, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসব বুদ্ধ পূর্ণিমা, এবং খ্রিস্টানদের বড়দিনের প্রচলন আছে। কলকাতার দুর্গা পুজোর উদ্দীপনা এদেশের সব উৎসবের আড়ম্বরকে ছাড়িয়ে যায়। তাই বুঝি বহু বিজ্ঞাপনে শারদোৎসবের নস্টালজিয়া বাঙালিকে করে তোলে আবেগমুখর।
বঙ্গ সংস্কৃতি কেবল উৎসব আর লোকাচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; নববর্ষে মিষ্টিমুখ আর হালখাতা, রথযাত্রার জিলিপি-পাঁপড়ভাজা, শারদীয়ায় আমিষ-নিরামিষ হরেকরকম পদ, নবান্ন-পৌষপার্বণে পিঠেপুলি, প্রাদেশিক মিষ্টির বিপুল সম্ভার বাংলার ও বাঙালির মন কাড়ার অমোঘ অস্ত্র।
বর্তমান সময়ে উৎসবে, উপহারে ও আনন্দে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে ইন্টারনেট। শুধু শহরেই নয়, গ্রামেও এখন বিভিন্ন প্রয়োজনে ইন্টারনেটের ব্যবহার করছে মানুষ। প্রযুক্তির উন্মেষের সাথে সাথে মানুষের কেনাকাটার পদ্ধতি ও তথ্য আহরণের চাহিদায় দেখা যাচ্ছে ব্যাপক পরিবর্তন। টিকিট বুকিং থেকে শুরু করে মুখরোচক খাদ্যের সম্ভার সবই এখন মুঠোফোনে উপলভ্য। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমগুলি বিনোদনের নতুন রাস্তা খুলে দিয়েছে মানুষের কাছে। শুধু বিনোদনই নয়, যুক্তি-তর্ক, অনলাইন খেলাধুলা, কেনাকাটা, ব্যবসা, পড়াশুনা ও নানানভাবে মানুষকে বেঁধে রাখছে এই সামাজিক গণমাধ্যমগুলি। বিভিন্ন সাইট ঘেঁটে, অফার, ডিল, ছাড়ের তুলনামূলক মানদন্ডে যাচাই করে তবে বাজার করার অভ্যেস তৈরি হচ্ছে মানুষের মধ্যে। চৈত্র সেল বা দুর্গা পুজোর মেগা অফার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সাজ-সরঞ্জাম, সবকিছুর সম্বন্ধে তথ্য জোগাড় করা হয়ে উঠেছে আরও সহজ। শুধু তাই নয়, নিজেদের প্রোডাক্টগুলি এখন গ্রাহকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানি।
ছোট বা বড় যেকোনও ব্যবসার সাফল্যের ক্ষেত্রে, গ্রাহকদের বুনিয়াদি প্রবণতা ও তাদের পছন্দ-অপছন্দগুলি বোঝা একান্ত গুরুত্বপূর্ণ। 2016 সালে ভারতবর্ষের 40.9 কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরমধ্যে আঞ্চলিক বা স্থানীয় ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় ষাট শতাংশ। KPMG-র রিপোর্ট অনুযায়ী পরবর্তী 32.6 কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে স্থানীয় ভাষায় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে প্রায় তিরানব্বই শতাংশ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
সুতরাং, ভারতের বৃহত্তর মার্কেটে আপন মাতৃভাষায় প্রযুক্তিগত উন্নতিকে সাদরে গ্রহণ করছে মানুষ। তাই তাদের কাছাকাছি পৌঁছাতে গেলে তাদের ভাষায় কথা বলে, তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে মর্যাদা দিয়ে ব্র্যান্ডগুলির মূল্যবোধ তুলে ধরাই আঞ্চলিকীকরণের পথে সাফল্য পাওয়ার শ্রেষ্ঠ পদক্ষেপ হবে।
April 26, 2021 — magnon