একবিংশ শতাব্দী: ভাষার বিবর্তন

Written by: Subhabrataa Biswas and Ananya Banerjee

বাংলা একটি ইন্দো-আর্য ভাষা যা পৃথিবীর প্রায় ২২ কোটি মানুষের মাতৃভাষা বা দ্বিতীয়ভাষা, মোট ব্যবহারকারীর দিক থেকে বিশ্বে যার স্থান ষষ্ঠ। ভাষাবিজ্ঞানের বিচারে বাংলা ভাষার উৎপত্তি ঘটে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারে। ১৫০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা বংশের একটি শাখা ভারতীয় আর্য ভাষা নামে ভারতে প্রবেশ করে। এই ভারতীয় আর্য ভাষা কালক্রমে তিনটি স্তরে বিবর্তিত হয়:

প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা (১৫০০ খ্রীঃ পূঃ – ৬০০ খ্রীঃ পূঃ): এই স্তরের প্রধান ভাষাটি হল বৈদিক ভাষা, যা থেকে উদ্ভব হয় সংস্কৃত।

মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা (৬০০ খ্রীঃ পূঃ – ৯০০ খ্রীঃ পূঃ): এই দেড় হাজার বছরে সংস্কৃতের আমূল বিবর্তন ঘটে এবং সংস্কৃতের ‘প্রকৃতি’(মূলরূপ) নিয়ে নতুন ভাষা প্রাকৃতের জন্ম হয়। অঞ্চল ভেদে ভারতে পাঁচরকম প্রাকৃতের প্রচলন ছিল- মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত, শৌরসেনী প্রাকৃত, পৈশাচী প্রাকৃত, মাগধী প্রাকৃত ও অর্ধমাগধী প্রাকৃত। পরবর্তী পর্যায়ে একেকটি প্রাকৃত থেকে একেকটি অপভ্রংশের জন্ম হয়।

নব্যভারতীয় আর্য ভাষা: এই স্তরে বিভিন্ন অপভ্রংশ থেকে নব্যভারতীয় আর্য ভাষাগুলির জন্ম হয়। ভাষাতাত্ত্বিকরা মনে করেন, আনুমানিক ৯০০ খ্রীঃ পূঃ থেকে মাগধী প্রাকৃতের অপভ্রংশের পূর্বী শাখা থেকে জন্ম নেয় বাংলা, অহমিয়া ও ওড়িয়া ভাষা। বাংলা ভাষা বিকাশের ইতিহাস আনুমানিক ১৩০০ বছরের পুরনো। চর্যাপদ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম পদ সঙ্কলন তথা সাহিত্য নিদর্শন যার রচয়িতা ছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ। এই গীতিপদাবলী আনুমানিক দ্বাদশ শতকের শুরু থেকে চতুর্দশ শতকের মাঝে কোনও সময় রচনা করা হয়েছিল। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজপরিবারের গ্রন্থাগার থেকে এটি আবিষ্কার করেন যাতে বাংলার বহু শব্দ ও ব্যাকরণের পুরাকালীন ছাপ স্পষ্ট। ক্রমশঃ আদিমধ্যযুগে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন (১৩৫০-১৪৫০ খ্রীষ্টাব্দ), অন্তঃমধ্যযুগে চণ্ডীমঙ্গল (ষোড়শ শতক) এবং মধ্যযুগে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল (১৭৫০ খ্রীষ্টাব্দ) দিয়ে বাংলা ভাষার বিবর্তনে মধ্যযুগের অবসান ও আধুনিক যুগের সূচনা হয়।

মনে রাখতে হবে, এই সময় পর্যন্ত গদ্য সাহিত্যের প্রচলন ছিল না। ষোড়শ শতাব্দী থেকে নিতান্ত প্রয়োজনে হিসাব-নিকাশ, চুক্তিপত্র, দলিল-দরখাস্ততে সীমিত ক্ষেত্রে গদ্যের ব্যবহার শুরু হয়। ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগ খোলার প্রেক্ষিতে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী সময়ের সূচনা হয়। শ্রীরামপুর কলেজ ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাশাপাশি রাজা রামমোহন রায় এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাত ধরে বাংলা গদ্য সাহিত্য বিকাশ লাভ করে। ১৮৬০ সালের পরবর্তী সময়টিকে আমরা আধুনিক বাংলার উন্মেষকাল হিসেবে ধরতে পারি। ক্রমান্বয়ে গদ্য নির্ভর সাহিত্য, গল্প, উপন্যাস, প্রহসন, প্রবন্ধ ও নাটকের বৈচিত্র্যে এবং মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, বিহারীলাল চক্রবর্তী কিংবা শরৎচন্দ্র চট্ট্যোপাধ্যায় প্রমুখের প্রতিভায় বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। এর পরে বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব সাহিত্যাঙ্গনে পৌঁছে দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯১৩ সালে এশীয়দের মধ্যে সাহিত্যে সর্বপ্রথম নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মাধ্যমে তিনি এই বার্তা পৌঁছে দেন যে বাংলা শুধুমাত্র একটি ভাষাই নয়, এই ভাষার সাহিত্য ও সাহিত্যিকেরা বিশ্বের তাবড় কৃতি প্রতিভাধারীদের সমকক্ষতা লাভেও সক্ষম। ১৮৬১ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত এই সময় বাংলা সাহিত্য হয়ে উঠে রবীন্দ্র প্রতিভায় উজ্জ্বল। সেজন্যই এই সময়কাল বাংলা সাহিত্যের রবীন্দ্রযুগ নামে খ্যাত। বাংলা ভাষার বিবর্তনে তৎকালীন সাহিত্যিকদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামের অবদানও অনস্বীকার্য। বিংশ শতকের প্রথমভাগে বুদ্ধদেব বসু, অচ্যিন্তকুমার সেন প্রমুখের হাতে বাংলা কথাসাহিত্য একটি দৃঢ় ভিত্তি লাভ করে। তবে বাংলা উপন্যাস নতুন মাত্রা লাভ করে মানিক বন্দ্যেপাধ্যায়, জগদীশ গুপ্ত ও কমলকুমার মজুমদারের হাতে। এদের হাতে উপন্যাস বড় মাপের পরিবর্তে মানবিক অস্তিত্বের নানা দিকের উপর আলোকপাত করে বিকশিত হয়।

রবীন্দ্রোত্তর যুগে ভারতের স্বাধীনতা এবং বাংলা ভাগের ফলে ভাষার আমূল পরিবর্তন আসে যার বাহন হিসেবে সংবাদপত্র এবং গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রচুর।  সংবাদপত্র হিসেবে আনন্দবাজার, যুগান্তর, অমৃতবাজার পত্রিকার শাণিত লেখনীতে গদ্য ও জনসাধারণের সহজবোধ্য পাঠ্যের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটে।

মুম্বাইয়ের (তৎকালীন বোম্বে) পরে কলকাতাই হল একমাত্র শহর যেখানে ব্রিটিশ শাসনপর্বেই রেডিও স্টেশন গড়ে ওঠে (১৯২৭ সাল, আগস্ট)। কিন্তু ধীরে ধীরে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তার প্রসার ঘটে- দূরদর্শন এবং আকাশবাণী  ভাষা বিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়।

১৯৯০-এর গোড়ার দিক পর্যন্ত মুদ্রণমাধ্যম বেশি প্রভাবশালী থাকলেও মুক্ত অর্থনীতির মানসিকতা অনুসরণ করে বৈদ্যুতিন মাধ্যম বাংলায় আসে। ২০১১-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় পনেরোটি স্যাটেলাইট চ্যানেল বাংলায় খবর সম্প্রচার করতে শুরু করে।

বিগত দুই দশকে আমরা পৃথিবীর সর্বত্রই প্রযুক্তির জয়গান দেখেছি। প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবন যাপনের ধরন। ভাষাতেও এর প্রভাব কম নয়। এমনিতেই ভাষা প্রবহমান নদীর মতো, যার হাজারো বাঁক। বাঁকে বাঁকে পরিবর্তনের ছোঁয়া। ইন্টারনেট এখন যোগাযোগের অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম। আর ইন্টারনেটের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহারও কেবল বিনোদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিতর্ক, জনমত তৈরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখন ব্যাপকভাবে ভূমিকা রাখছে এটি। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের প্রভাবে পাল্টাতে শুরু করেছে আমাদের সামগ্রিক জীবনযাত্রা। ফেসবুক, ব্লগ ইত্যাদি হয়ে উঠেছে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চার মাধ্যম।

প্রতিদিন সারা পৃথিবীতে অগণিত মানুষ ইন্টারনেট বা অন্তর্জালের সংস্পর্শে আসছেন যেখানে আছে নানা বিষয়ের বিপুল সংখ্যক ওয়েবসাইট। আছে নানা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম— ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদি। এইসব সামাজিক যোগাযোগ সাইট তৈরি করেছে এক ‘ভার্চুয়াল’ সামাজিক বাস্তবতা, যার প্রভাবে মানবীয় সম্পর্কগুলোতেও আসছে নতুন মাত্রা। আর এই পরিবর্তনের অন্যতম বড় প্রভাবক হচ্ছে ভাষা।

বাংলার লিখিত রূপ বদলের বড় ঢেউটি আসে মূলত গত দশকের শেষভাগে। যখন থেকে বাংলা ভাষায় ব্লগ জনপ্রিয় হতে শুরু করে। এর আগে সাহিত্যচর্চায় ভাষা নিয়ে লেখকদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা থাকলেও তা এত ব্যাপক আকারে কখনোই সাধারণ মানুষের এত বড় অংশের কাছে পৌঁছায়নি। বিভিন্ন ব্লগে বিপুল সংখ্যক ব্লগার, বলা চলে, অনেকটা যার যার নিজস্ব রীতিতেই লিখে থাকেন। কাজেই লেখা-লিখির মধ্যে ভাষার গঠনের যে পরিবর্তন তা অনায়াসেই লক্ষ্য করা যায়।

শুধু বাংলা ভাষা চর্চাই নয়, বরং বাংলা ভাষা সম্পর্কিত সম্পদ ও সংস্থানের বিকাশ এবং সেগুলি সাধারণ মানুষের কাছে উপলভ্য করে তোলায় গত দশক থেকে প্রভূত প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি এখন শুধুমাত্রই সাহিত্যের বেড়াজালেই আবদ্ধ না থেকে সংবাদ, সিনেমা, মোবাইল, কবিতা, ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া এবং অন্যান্য বহু মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রযুক্তির উদ্ভাবনে অভিজ্ঞ থেকে একেবারে অপটু মানুষ, সবাই ভাষার সেই বিবর্তনের শরিক হয়েছেন। যে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন আজ থেকে দশ বছর আগেও শহুরে অভিজাতের জন্য তৈরি করা হয়েছিল, তা এখন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে খেটে খাওয়া মানুষও বাংলায় ব্যবহার করতে পারছেন। ফেসবুক, গুগলের মতো প্রযুক্তিবিশারদ কোম্পানির সাথে ছোট-বড় বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যবসা বাংলা ভাষায় নিজেদের উদ্যোগ স্থানীয়করণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আশা করা যায় আগামী এক বা দুই দশকের মধ্যে বাংলার ঘরে ঘরে স্মার্টফোন থাকবে এবং ভাষার গন্ডী অতিক্রম করে মানুষ  নিজের মাতৃভাষায় বিশ্বের যাবতীয় তথ্য আহরণ করতে পারবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *