লোকালাইজেশন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজের সুযোগ

Written by: Ananya Banerjee

১৯৮০’র দশকে স্থানীয় ভাষায় অনুবাদ থেকে বিশ্বায়ন ও আন্তর্জাতিকীকরণের পথে হেঁটে লোকালাইজেশন (স্থানীয়করণ) ইন্ডাস্ট্রির সূচনা হয় । এই দশকেই ডেস্কটপ কম্পিউটারের ব্যবহার শুরু হয় এবং কম্পিউটার প্রযুক্তি এমন অনেক ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছতে থাকে যাদের কম্পিউটার প্রোগ্রামিং বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিশেষ কোনও জ্ঞান ছিল না। ১৯৮০’র গোড়ার দিকে মার্কিন কম্পিউটার হার্ডওয়্যার এবং সফ্টওয়্যার ফার্মগুলি প্রথম আন্তর্জাতিক উদ্যোগ-বিনিয়োগে আগ্রহী হতে থাকে। প্রথম দৃষ্টান্ত মাইক্রোসফ্ট, যারা ১৯৭৮ থেকে ১৯৭৯-র মধ্যে টোকিও এবং ইউরোপে সেলস অফিস খোলে, পরে সান মাইক্রোসিস্টেমস সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে ইউরোপ, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় ব্যবসার প্রসার ঘটায়। 

কর্পোরেট বা শিক্ষামূলক কাজে নয়, বরং সাধারণ ব্যবহারকারীদের ডেস্কে কম্পিউটার হার্ডওয়্যার ও সফ্টওয়্যার পৌঁছে যাওয়ায় প্রোডাক্ট ও পরিষেবার বৈশিষ্ট্য স্থানীয় মান ও চর্চার সাথে তাল রেখে অল্পবিস্তর বদলানো প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে; প্রয়োজন হয় লোকালাইজেশন বা স্থানীয়করণের। এই বিষয়ে এগোনোর আগে, এই শিল্পক্ষেত্রের ব্যাপ্তি বোঝার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দের সাথে পরিচয় করা যাক: বিশ্বায়ন, আন্তর্জাতিকীকরণ, স্থানীয়করণ এবং অনুবাদ (GILT; Globalization, Internationalization, Localization and Translation)। এই প্রেক্ষাপটে ‘বিশ্বায়ন’ বলতে বোঝায় ব্যবসা বা সংস্থাগুলির আন্তর্জাতিক স্তরে প্রভাব সৃষ্টি বা বিশ্ব জুড়ে ব্যবসা পরিচালনা করা।  ‘আন্তর্জাতিকীকরণ’ মানে হল কোনও পণ্য, অ্যাপ্লিকেশন বা ডকুমেন্টকে এমনভাবে বানানো যাতে তা লক্ষিত ভিন্ন ভাষা, অঞ্চল বা সংস্কৃতির মানুষের জন্য স্থানীয়করণ করার পক্ষে সহজ হয়ে ওঠে। ‘স্থানীয়করণ’ হল লক্ষিত অঞ্চল, ভাষা ও সংস্কৃতির খুঁটিনাটিকে অগ্রাধিকার দিয়ে কন্টেন্টের ভাষাতাত্ত্বিক রূপান্তর করা যাতে তা স্থানীয় ভাষাভাষী মানুষের পক্ষে গ্রহণযোগ্য ও সহজে বোধগম্য হয়। অনুবাদ হল পদ্ধতিগতভাবে এক ভাষা থেকে কন্টেন্ট অন্য ভাষায়

রূপান্তর।  এই পরিভাষাগুলিতেই স্পষ্ট,  স্থানীয়করণের প্রথম ধাপ অনুবাদ হলেও, স্থানীয়করণ একটি বহুমুখী প্রক্রিয়া।

সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১২ সালে বিশ্ব অনুবাদের বাজার ছিল ৩৩৫০ কোটি মার্কিন ডলারের, প্রতি বছর এই অঙ্কটি আনুমানিক ৫.১৩% হারে বাড়ছে। সুতরাং, এশিয়ার অনুবাদ ও লোকালাইজেশন শিল্পের ১৯ শতাংশই ভারতের হাতে থাকায়, ক্রমবর্ধমান ভারতীয় অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে যে এই শিল্পক্ষেত্রে পেশার বিপুল সুযোগ আছে তা বলাই বাহুল্য।

আলোচনার সুবিধার্থে অনুবাদ ও স্থানীয়করণ শিল্পে পেশার সুযোগকে তিনটি শ্রেণীভুক্ত করা যায়: ভাষাতাত্ত্বিক, প্রযুক্তিগত এবং ব্যবসাকেন্দ্রিক পেশা।

ভাষাকেন্দ্রিক শিল্পের মূল ভিত হিসেবে, ভাষাতত্ত্বের পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিরা ক্লায়েন্টের প্রয়োজন মতো এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় বিষয় (বা কন্টেন্ট) অনুবাদ করেন। যারা মূলত এই পেশায় কাজ শুরু করেন তারা দ্বিভাষিক বা বহুভাষিক প্রেক্ষাপট থেকে আসেন এবং তাদের ঝুলিতে ভাষা/অনুবাদ সংক্রান্ত ডিগ্রী ও কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থাকে। ভাষাতাত্ত্বিকরা শুধুই যে অনুবাদের কাজ করেন তা নয়, বরং দোভাষী, এডিটর, প্রুফরিডারের মতো দায়িত্ব পালনেও দক্ষ হন। লিখিত বা মৌখিক ভাষান্তরণ যাই হোক না কেন, ট্রান্সলেশন মেমরি (TM), কম্পিউটার অ্যাসিস্টেড ট্রান্সলেশন (CAT) টুল,  টেক্সট এডিটর সফ্টওয়্যার, দোভাষীর কাজ করলে ভিডিও রিমোট ইন্টারপ্রেটিং (VRI), ওভার দ্য ফোন ইন্টারপ্রিটেশন (OPI) ইত্যাদির মতো সাম্প্রতিক প্রযুক্তির সাথে পরিচিত হওয়া উপরি পাওনা হিসেবে কাজ করে।

যেহেতু তথ্য এবং কন্টেন্ট বিভিন্ন ডিজিটাল ফর্ম্যাটে তৈরি হয়, তাই অনুবাদ ও স্থানীয়করণের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত পেশার ভূমিকাও অনস্বীকার্য।  সফ্টওয়্যার থেকে ওয়েবসাইট ডকুমেন্টেশন, বিভিন্ন ডিভাইস এবং প্রযুক্তিগত পণ্য ও প্ল্যাটফর্ম, অনুবাদ হতে চলা যে কোনও কন্টেন্ট প্রযুক্তিগতভাবেও প্রক্রিয়াকরণের দরকার পড়ে। লোকালাইজেশন কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স (QA) পেশায় যুক্ত ব্যক্তিরা কোনও প্রযুক্তিগত পণ্যের চূড়ান্ত রূপের গুণমান, কার্যকারিতা এবং খুঁটিনাটি দিকগুলির বিষয় তত্ত্বাবধান করেন। এর পরে উল্লেখ করতেই হয় লোকালাইজেশন ইঞ্জিনিয়ারের পেশা, যারা অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা থাকা কোনও পণ্য, ডকুমেন্ট, ওয়েবসাইট বা ডিভাইস নিয়ে সরাসরি কাজ করেন। ভাষা-সংক্রান্ত পরিষেবা প্রদানকারী বা ল্যাঙ্গুয়েজ সার্ভিস প্রোভাইডারদের (LSP) সাথে কাজ করার সময় এরা লোকালাইজেশন ও অনুবাদের কাজের জন্য দরদাম ঠিক করতে ফাইল মূল্যায়ন করেন। অনুবাদ হয়ে গেলে ফাইলগুলিকে একত্রিত করে চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট ফর্ম্যাট অথবা সিস্টেমে সংযোজিত করা এবং ভুলত্রুটি যাচাই ও

সংশোধনের জন্য লোকালাইজেশন কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স টিমের সাথে কাজ করার ভারও লোকালাইজেশন ইঞ্জিনিয়ারদের উপরে থাকে।  এই দুটি পেশার ক্ষেত্রেই অনুবাদ এবং লোকালাইজেশন সংক্রান্ত উন্নততর প্রযুক্তি নখদর্পণে থাকা জরুরি। 

কেউ যদি ভাষার পাশাপাশি ব্যবসায়িক বিষয়ে পারদর্শী হন, তাহলেও এই শিল্পক্ষেত্রে হাতছানি দেওয়ার মতো কিছু কাজের সুযোগ মিলতে পারে। লোকালাইজেশনের বাজেট ঠিক করা, যথাযথ অনুবাদক, ভাষাতাত্ত্বিক বা সংশ্লিষ্ট কর্মচারী নিয়োগ, ক্লায়েন্টের সাথে কোনও প্রোজেক্টের সময়সীমা ঠিক করা, পারদর্শিতার ভিত্তিতে উপযুক্ত ভেন্ডর ও আভ্যন্তরীণ কর্মচারীদের লোকালাইজেশনের নির্দিষ্ট প্রোজেক্টের দায়িত্ব দেওয়া ইত্যাদি ভূমিকা পালন করেন প্রোজেক্ট ম্যানেজার, স্ট্র্যাটেজিস্ট, ভেন্ডর ম্যানেজাররা, যে পেশাগুলি তথাকথিত ‘লোকালাইজেশন ম্যানেজমেন্ট’ বিভাগে পড়ে। 

তবে এই বিভাগগুলি পৃথক হলেও বিচ্ছিন্ন নয়। সুতরাং, কেউ যদি মনে করেন, ভাষাতাত্ত্বিক হিসেবে পেশায় পা রাখার পরে অভিজ্ঞতা ও পারদর্শিতা অর্জন করে ব্যবসায়িক বা প্রযুক্তিগত পেশায় যাবেন, সেটিও সম্ভব। 

এ তো গেল বিস্তৃত শ্রেণীবিভাগগুলির কথা। কিন্তু যারা নিছকই ভাষাতাত্ত্বিক হিসেবে লোকালাইজেশনের মূল পেশাগুলিতে যুক্ত হতে চান তাদের জন্য আরও কিছু কাজের ভূমিকা উল্লেখ না করলেই নয়।

প্রথমত, অনুবাদক বা দোভাষীর ভূমিকায় বর্তমানে বহু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বিশিষ্টতা লাভ করা যায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল তথ্যপ্রযুক্তি, সফ্টওয়্যার, গেম, আইন, মেডিকেল, মেডিকো-লিগ্যাল (চিকিৎসা ও চিকিৎসামূলক পরীক্ষানিরীক্ষা সম্বন্ধীয় আইনি বিষয়), শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিমা ও ব্যাঙ্কিং, আর্থিক এবং মিডিয়া। এই ক্ষেত্রগুলিতে বিশিষ্টতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারলে বহু কর্পোরেট সংস্থার পাশাপাশি মিলতে পারে ফার্মা কোম্পানি, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সরকারি প্রতিষ্ঠান, ল ফার্ম ও আদালতে কাজের সুযোগ। বহু বিজ্ঞাপন সংস্থা, স্ট্রিমিং পরিষেবা, ই-কমার্স, ই-লার্নিং সংস্থা আজকাল ভিডিও মাধ্যমে নিজেদের বার্তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে আগ্রহী হচ্ছেন। সেক্ষেত্রে করতে পারেন ভিডিও সাবটাইটেল বা ট্রান্সক্রিপশনের কাজও।  বর্তমান কোভিড-অতিমারি পরিস্থিতির নিরিখে, ঘরে বসে আংশিক সময় বা ফ্রিল্যান্সে কাজ করার সুবিধাও একটি উপরি পাওনা।  সৃজনশীল মনস্কদের জন্য ব্লগ অনুবাদ, ট্রান্সক্রিয়েশনের কাজ এবং প্রযুক্তিপ্রিয় মানুষদের জন্য ইউজার ইন্টারফেস (UI), অ্যাপ, গেমিং, সফ্টওয়্যার অনুবাদ আকর্ষণীয় হতে পারে। দেশীয় মুদ্রায় উপার্জনের সাথে বিদেশী ল্যাঙ্গুয়েজ সার্ভিস প্রোভাইডারের (LSP) সঙ্গে কাজ করলে রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রায় আয়ের সুযোগ।

Google, Facebook, Amazon-এর মতো তাবড় টেক জায়ান্ট কোম্পানির পাশাপাশি এখন বহু আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় সংস্থাও, জনসংখ্যার নিরিখে দ্বিতীয় দেশ, ভারত জুড়ে ব্যবসার প্রসার ঘটাতে এবং গ্রাহকসংখ্যা বাড়াতে লোকালাইজেশনে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছে।  কোভিড-পরবর্তী কাজের বাজার অন্যান্য ক্ষেত্রে নিম্নমুখী হলেও, লোকালাইজেশন বা স্থানীয়করণের চাহিদা তো কমেইনি, বরং বেড়েছে। কাজেই নতুন পেশার অন্বেষণ হোক, বা পেশা পরিবর্তন, অনুবাদ এবং লোকালাইজেশন ইন্ডাস্ট্রি আপনার বিবেচনা তালিকার শীর্ষে থাকার দৌড়ে এক কদম এগিয়ে রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *